এক ধনীর দুলালের ভয়ঙ্কর জীবন
- আমিনুল ইসলাম
- ০৫ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৪২, আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৮, ১৪:৫৫
শুরুটা সিগারেট দিয়ে। প্রথমে আড়ালে আবডালে একটি দু’টি টান। কিছু দিন যেতেই পুরো সিগারেট শেষ। এরপর আর লুকোতে ইচ্ছা করত না। জনসম্মুখে সিগারেট টানতে ইচ্ছা করত খুব। তবে প্রথমে ভয় হতো পরিচিত কারো সামনে পড়ে যাই কিনা। কিন্তু না সব বাধা পেরিয়ে এক সময় রাস্তার ফুটপাথ দিয়ে দুই আঙুলের মধ্যে জ্বলন্ত সিগারেট গুঁজে হাঁটতে শুরু করি। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বড় ভাইদের সাথে মিশে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার পর ক্ষমতার দাপটে নিয়ম ভাঙাই যেন নিয়মে পরিণত হয়ে যায়। সিগারেটের সাথে শুরু হয় গাঁজা আর ফেনসিডিল। এরপর মদ ইয়াবা থেকে শুরু করে সব ধরনের মাদকের স্বাদ নেয়া হয়েছে। কথাগুলো বলছিলেন একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। একটি বাহিনীর উচ্চপদস্থ (সাবেক) কর্মকর্তার সন্তান তিনি। দুই বোন এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বড় দুই বোনই বিসিএস ক্যাডার অফিসার।
ভালো ছাত্র হয়েও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার কারণে আজ তার কিছুই নেই। নাম প্রকাশ করতে চাননি বলেই তার ছদ্ম নাম দেয়া হলো তারেক। সাভারের মাদকাসক্ত নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় তারেকের।
তারেক জানান, ২০০২ সালে মিরপুরের মনিপুর স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন তিনি। সেই সময়ে একটি সাবজেক্টে এ+ থাকেনি বলে তিনি জিপিএ ৫ পাননি। স্কুলে থাকতে খেলাধুলায় মন ছিল বেশি। কিন্তু ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়ার পর নতুন বন্ধুদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। আর তাদের একেকজনের একেক রকম ইচ্ছা। শুরু হয় বন্ধুদের সাথে আড্ডা। এক সময় তাদের সাথেই সিগারেটে হাতেখড়ি। প্রথমে লুকিয়ে-আড়ালে আবডালে বসে সিগারেট টান শুরু করেন। ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে রাস্তায় সিগারেট টানতে শুরু করে। ঢাকা কলেজ থেকে সুযোগ পেয়ে জান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন স্বপ্ন দেখতে থাকেন আকাশ সমান। কিন্তু রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে স্বপ্ন বাস্তবায়নের আগেই ক্ষমতা এসে যায় হাতের মুঠোয়।
টাকার জোগাড় করতেও বেগ পেতে হয় না। এর মধ্যেই বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে সিগারেটের সাথে শুরু হয় গাঁজা সেবন। একপর্যায়ে এক বড় ভাই তাকে জানায়, ফেনসিডিলে শরীর স্থির হয়। এর মজাই আলাদা। তার কথায় শুরু করেন ফেনসিডিল সেবন। ধীরে ধীরে ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। মাদকের ওপর আসক্ত হয়ে পড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বেরোনো সম্ভব হয়নি। পরিবারে শুরু হয় চরম অশান্তি। একমাত্র ছেলের দুরবস্থা দেখে হতাশায় ভুগতে থাকেন অসুস্থ বাবা-মা ও বোনরা। তারা বিভিন্নভাবে বোঝাতে থাকেন তারেককে। কিন্তু তাদের প্রতিটি ভালো কথাও তারেকের কাছে বিষের মতো মনে হতে শুরু করে।
তারেক জানান, যখন নেশাগ্রস্ত অবস্থা ছাড়া স্বাভাবিক থাকেন তখন বাবা-মা, পরিবার, সমাজে স্ট্যাটাস নিয়ে ভাবতে থাকেন। আত্মীয়স্বজনের চোখে কতটা ছোট হয়ে আছেন তিনি ও তার পরিবার তা ভেবে কান্নায় চোখ ভিজে যায় তার। ভাবতে থাকেন আর কখনো মাদক সেবন করবেন না। কিন্তু নেশা পেলে সব ভুলে যেতে থাকেন। তখন মনে হয় নেশাই তার জীবনের সব। একপর্যায়ে তারেক আবারো লেখাপড়া শুরু করেন। ভর্তি হন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটি চাকরি শুরু করেন।
কিন্তু কোথায়ও শান্তি পাচ্ছিলেন না। কারণ মাদক তার পিছু ছাড়ছিল না। যেখানেই যাচ্ছিলেন সেখানেই তার মতো মাদকসেবীদের সন্ধান পেয়ে যাচ্ছিলেন। তারাও বুঝে যাচ্ছিল তারেক মাদকসেবী। আবার নতুন করে শুরু হচ্ছিল মাদক সেবন। চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় করতে গিয়েও একই অবস্থায় পড়েন তিনি। সেখানেই নতুন নতুন মাদকাসক্ত তার চারপাশে ঘিরে থাকে। ব্যবসাও শেষ হয়ে যায়। স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে যায় তার। একপর্যায়ে বোন ও বাবা-মায়ের চাপে পড়ে সুস্থ হওয়ার বাসনা নিয়ে গত দুই মাস আগে ভর্তি হন মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে। কিন্তু প্রথম দিক চিকিৎসা নিতে একেবারেই ইচ্ছা করত না। তারপরও নিজের অসুস্থতা, বাবা-মায়ের কান্না, সমাজের চোখে ছোট হয়ে থাকার কারণে প্রবল ইচ্ছা শক্তি নিয়ে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন। এখন অনেকটাই সুস্থ তিনি। আর ফিরে যেতে চান না ওই ভয়ঙ্কর জীবনে। আবার ফিরে যেতে চান বাবা-মায়ের সুখের সংসারে। শুরু করতে চান নতুন জীবন।
বাংলাদেশ মাদকাসক্ত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র ‘বারাকা’র এডিকেটর এডিকেশন জাকিউল আলম মিলটন বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সিগারেট দিয়েই মাদক সেবনের সূত্রপাত হয়ে থাকে। আর সেটি হয়ে থাকে মূলত বন্ধুদের মাধ্যমে। এরপর ধীরে ধীরে তা নারকোটিকস জাতীয় মাদকের দিকে ধাবিত হয়। আর তখনই তাকে মাদকাসক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অনেক আগে থেকে দেশে মাদকের প্রচলন থাকলেও মূলত আশির দশকে নারকোটিকস জাতীয় ড্রাগের অনুপ্রবেশের পর থেকে মাদক সমস্যা ব্যাপকতা লাভ করতে থাকে।